ওসমান হাদির মৃত্যুর পর থেকে বাংলাদেশে পরিস্থিতি ক্রমশ আরও উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। রাজধানী ঢাকা আপাতদৃষ্টিতে শান্ত মনে হলেও, বাস্তবে শহরজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে ভয়, অনিশ্চয়তা ও আতঙ্ক। রাস্তাঘাট, বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর থেকে শুরু করে সংবাদমাধ্যমের অফিস সব জায়গাতেই বিরাজ করছে চাপা উৎকণ্ঠা।
সবচেয়ে বেশি আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন জগন্নাথ হলে। এখানে মূলত হিন্দু ও অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ছাত্রছাত্রীরা বসবাস করেন। হাদির মৃত্যুর পর যে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে, তার অভিঘাত এই এলাকাতেই সবচেয়ে গভীরভাবে অনুভূত হচ্ছে। কারণ অতীতেও, বিশেষ করে জুলাই ২০২৪-এ, এই অঞ্চলেই একাধিক হামলা, অশান্তি ও গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছিল।
সাম্প্রতিক পরিস্থিতির জেরে জগন্নাথ হলের পড়ুয়ারা কার্যত নিজেদের নিরাপত্তার জন্য হস্টেলের প্রধান গেটে একাধিক তালা ঝুলিয়ে ভেতরেই অবস্থান করছেন। শীতকালীন ছুটি শুরু হলেও বহু ছাত্র বাইরে যেতে সাহস পাচ্ছেন না। পড়াশোনা ও খেলাধুলা চললেও, জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কেউই হস্টেল ছেড়ে বের হচ্ছেন না। ভয় এতটাই গভীর যে, ক্যামেরার সামনে কথা বলতে রাজি নন কোনো পড়ুয়াই।
বিশেষ করে সাম্প্রতিক দীপু দাস সংক্রান্ত ঘটনার পর থেকে বাংলাদেশের হিন্দু সমাজের মধ্যে উদ্বেগ আরও বেড়েছে বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা।
১৮ ডিসেম্বর রাত প্রায় বারোটা নাগাদ হাদির মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়তেই ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। একদল উন্মত্ত জনতা রাস্তায় নেমে এসে দেশের শীর্ষ সংবাদমাধ্যমগুলিকে লক্ষ্য করে হামলা চালায়। কারওয়ান বাজারে প্রথম আলোর প্রধান কার্যালয়ে অগ্নিসংযোগ করা হয়, যার ফলে অফিসটি সম্পূর্ণভাবে ভস্মীভূত হয়ে যায়। আজও সেখানে পড়ে আছে পোড়া কাগজ, ছাই ও ভাঙা কাঁচ।
একইভাবে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয় ডেইলি স্টার-এর অফিস। ভাঙচুর ও আগুনের চিহ্ন এখনও স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান। যদিও এলাকায় এখন প্রচুর পুলিশ মোতায়েন রয়েছে, তবুও ঢাকা শহরকে এখনও অত্যন্ত সংবেদনশীল বলেই মনে করা হচ্ছে।
সহিংসতার হাত থেকে রেহাই পায়নি দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ছায়ানট-ও। হামলার পর ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ এবং র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) ওই সব এলাকায় নজরদারি আরও জোরদার করেছে।
ঘটনার ধারাবাহিকতা স্পষ্ট করে দিয়েছে, লক্ষ্যবস্তু শুধু সংখ্যালঘু সম্প্রদায় নয় স্বাধীন সংবাদমাধ্যম ও সাংস্কৃতিক পরিসরও আক্রমণের মুখে পড়ছে। প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের মতো প্রতিষ্ঠানে হামলা দেশের গণতান্ত্রিক কাঠামো ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তুলে দিয়েছে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষ জানেন না, পরবর্তী ঘটনা কোথায় বা কখন ঘটবে। বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশ এখন এমন এক বিপজ্জনক অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে, যা কার্যত আগ্নেয়গিরির ওপর বসে থাকার মতো—যে কোনো মুহূর্তে বড় বিস্ফোরণ ঘটতে পারে।
- Log in to post comments